Ad 3

Education makes a door to bright future

University admission and others information,International Scholarships, Postgraduate Scholarships, College Scholarship, Study Abroad Financial Aid, Scholarship Search Center and Exam resources for PEC, JSC, SSC, HSC, Degree and Masters Examinees in Bangladesh with take from update sports News, Live score, statistics, Government, Private, current Job Circular take from this site

Education is a way to success in life

University admission and others information,International Scholarships, Postgraduate Scholarships, College Scholarship, Study Abroad Financial Aid, Scholarship Search Center and Exam resources for PEC, JSC, SSC, HSC, Degree and Masters Examinees in Bangladesh with take from update sports News, Live score, statistics, Government, Private, current Job Circular take from this site

Education is a best friend goes lifelong

University admission and others information,International Scholarships, Postgraduate Scholarships, College Scholarship, Study Abroad Financial Aid, Scholarship Search Center and Exam resources for PEC, JSC, SSC, HSC, Degree and Masters Examinees in Bangladesh with take from update sports News, Live score, statistics, Government, Private, current Job Circular take from this site

Education makes a person a responsible citizen

University admission and others information,International Scholarships, Postgraduate Scholarships, College Scholarship, Study Abroad Financial Aid, Scholarship Search Center and Exam resources for PEC, JSC, SSC, HSC, Degree and Masters Examinees in Bangladesh with take from update sports News, Live score, statistics, Government, Private, current Job Circular take from this site

Education is a key to the door of all the dreams

University admission and others information,International Scholarships, Postgraduate Scholarships, College Scholarship, Study Abroad Financial Aid, Scholarship Search Center and Exam resources for PEC, JSC, SSC, HSC, Degree and Masters Examinees in Bangladesh with take from update sports News, Live score, statistics, Government, Private, current Job Circular take from this site

Showing posts with label রচনা. Show all posts
Showing posts with label রচনা. Show all posts

Friday, March 18, 2022

রচনা : ডিজিটাল বাংলাদেশ [ ৩টি রচনা ]

 রচনা : ডিজিটাল বাংলাদেশ [ ৩টি রচনা ]

রচনা : ডিজিটাল বাংলাদেশ [ ৩টি রচনা ] 

↬ দিন বদলের পালায় বাংলাদেশ

ভূমিকা : বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আধুনিক এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য ও সত্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে। সময়ের বিবর্তনে রাজনীতি, অর্থনীতি, জলবায়ুর পরিবর্তনসহ নানা কারণে দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিশ্বপ্রেক্ষাপট। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তির অনেক উন্নতি ঘটেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশেও লেগেছে প্রযুক্তির নামের জাদুর কাঠির ছোঁয়া। যার নাম ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’

ডিজিটাল বাংলাদেশ : ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো কম্পিউটার এবং উন্নতর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া এবং জবাবদিহিতার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এটি একটি যুগোপযোগী, কিছুটা ব্যাপকভিত্তিক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, এ পরিকল্পনার মাধ্যমে ই-গভর্নেন্স, ই-কৃষি, ই-স্বাস্থ্য, ই-বাণিজ্য, ই-ভূমি মালিকানা, ই-শিক্ষাসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক সেবা নিশ্চিত করাই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য।

ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার উদ্ভব : নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’-এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন থেকেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার উদ্ভব।

ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি : সাধারণভাবে বলতে গেলে একটি ডিজিটাল সমাজ নিশ্চিত করবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে পর্যাপ্ত অনলাইন প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ করতে গেলে এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিশেষ নজর দিতে হবে। 

যেমন :

ক. বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলা : সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্ছ ১০,০৮৪ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে, যা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই এ কথা মনে রাখতে হবে যে, একটি পরিপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো গড়ে ওঠার জন্য যথাযথ বিদ্যুতের ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। তাই বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।

খ. ইন্টারনেট ব্যবহার সম্প্রসারণ : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য একটি দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সুপার হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমুদ্র তলদেশের সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন ও বাস্তবতা : বিশ্বায়ন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বলতে গেলে বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি দ্রুত প্রসারের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আজ তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য মোবাইল ফোনের ব্যবহার। এটি বাংলাদেশের যোগাযোগ মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে অনেকখানি দূরে। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ SEA-ME-WE4 সাবমেরিন ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্ন বাস্তবায়নে ইন্টারনেট কাঠামোর উন্নয়ন ও ইন্টারনেটের ব্যয় সাধারণের সীমার মধ্যে এনে সকল জনগণের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর না হয় বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপে গড়ার যে স্বপ্ন তা স্বপ্নই থেকে যাবে, বাস্তবে রূপান্তরিত হবে না।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে গৃহীত পদক্ষেপ : ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেগুলোর কিছু অংশ নিচে উল্লেখ করা হলো : 

১. ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) : ১৭ জুন ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাাচনে সীমিত পরিসরে কার্যকর হয়।

২. ই-ফাইল বা ডিজিটাল ফাইল : ডিজিটাল প্রশাসনের প্রথম ধাপ হিসেবে ও জানুয়ারি ২০১০ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ডিজিটাল নথি নম্বর চালু করে।

৩. মোবাইল মানি অর্ডার : এক ঘণ্টার মধ্যে টাকা পৌঁছানোর এ মোবাইল মানি ওর্ডার সার্ভিসটি ৯ মে ২০০৯ সালে ডাক বিভাগে চালু হয়।

৪. অনলাইন জিডি : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের থানাগুলোতে ৫ মে ২০১০ সালে কার্যক্রম শুরু হয়।

৫. আইসিটি মোবাইল ল্যাব : প্রথমবারের মতো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে এটি চালু হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে।

৬. অনলেইন টেন্ডার : সরকারি ক্ষেত্রে প্রথম ভূমি প্রশাসনে এটি চালু হয় ৪ অক্টোবর ২০০৯ সালে।

৭. মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট : ১ মে ২০১০ সালে ইস্যু করা হয়।

৮. প্রাথমিক পাঠ্যবইয়ের ওয়েব : চালু হয় ৪ জানুয়ারি ২০১০ সালে।

৯. দেশের ৬৪ জেলায় ওয়েব পোর্টাল www.dc(Zillaname)gov.bd চালু হয় ৬ জানুয়ারি ২০১০ সালে।

১০. মোবাইলে কৃষি সেবা : বাংলাদেশের বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানি কৃষি সেবার জন্য কৃষকদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে।

১১. টেলিমেডিসিন সেবা : ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিষয়ক যে কোনো সমস্যার সমাধান এবং প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে।

১২. ই-শিক্ষা : বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য, আবেদন, ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিজ নিজ স্থান থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানা যায়। তাছাড়া পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। মাধ্যমিকের টেক্সট বইও এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।

১৩. হাইটেক পার্ক ও কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপন : আইসিটি টাস্কফোর্স গঠন, আইটি শিল্পের বিকাশ ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন, দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, আইসিটি ইনকিউবেটর এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

উপসংহার : বর্তমান পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবী। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। এ স্বপ্নকেই ধারণ করছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বে যে জাতি তথ্যপ্রযুক্তিতে যত বেশি দক্ষ তাদের সার্বিক অবস্থাও তত বেশি উন্নত। নানারকম প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপে গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে সবাইকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক যত্নশীল হতে হবে।

একই রচনা অন্য বই থেকে সংগ্রহ করে আবার দেয়া হলো

ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৭১ সালে। তারপর থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে গড়ে তোলার সংগ্রাম শুরু। স্বাধীনতার ৪৭ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও আমরা উন্নয়নশীলতার গণ্ডি থেকে বের হতে পারি নি। আসে কি আশানুরূপ অগ্রগতি। এর পেছনে প্রতিবন্ধক হয়ে আছে আমাদের আলস্য, নৈতিকতার অভাব, কাজের চেয়ে বেশি কথা বলার প্রবণতা এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অগ্রসর না হওয়া ইত্যাদি। ফলে আমাদের সবকিছুই হচ্ছে মন্থর গতিতে। এই মন্থরতা কাটিয়ে দেশের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা সৃষ্টিতে ডিজিটাল পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ডিজিটাল পদ্ধতি বাংলাদেশের সকল কর্মকাণ্ডের সাথে ক্রমান্বয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার সংযুক্ত হলেই গড়ে ওঠবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।

ডিজিটাল বাংলাদেশ কী? : আমাদের প্রধানমন্ত্রি বাংলাদেশকে ২০২০ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ডিটিজাল বাংলাদেশ বলতে আমরা সংক্ষেপে যা বুঝতে পারি তা হলো- সারা দেশে কর্মকাণ্ডকে আধনিক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সিস্টেমের মাধ্যমে অর্থাৎ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দিয়ে গতিশীল করে তোলা। সরকারি অফিস-আদালত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ ও হাইওয়ে রোডগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে কম্পিউটারের ইন্টারনেট সিস্টেমে এক জায়গায় বসে বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড এবং বহির্বিশ্বেকে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে যে সফলতা অর্জিত হবে, তাকেই আমরা বলতে পারি ডিজিটাল বাংলাদেশ। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করাকে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।

শিক্ষা ক্ষেত্রে : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের লেকচার বা বক্তব্য ভিডিও করে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেওয়ালে সাদা পর্দায় তা প্রদর্শন করা যায়। এটি শিক্ষাথৃীদের মনোযোগ আকর্ষণের সহজ পদ্ধতি। কোনো শিক্ষকের শারীরিক সমস্যা দেখা দিলেও এ পদ্ধতিতে সহজে কাজ সম্পন্ন হতে পারে। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে এ পদ্ধতিতে ঘরে বসেও শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। নিজস্ব বই না থাকলেও, লাইব্রেরিতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না- ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট থেকে খুঁজে নিয়ে তা পড়ে ফেলা যায়। এভাবে ডিজিটাল পদ্ধতি শিক্ষাক্ষেত্রে উৎকর্ষ বয়ে আনতে পারে। তবে একে সর্বজনীন করার জন্য ব্যাপক সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে : চিকিৎসা নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান এক নতুন বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞানীদের সাধনায় একদিকে যেমন আবিষ্কৃত হযেছে নাা জটিল রোগের ঔষধ, তেমনি চিকিৎসার পদ্ধতিও ক্রমে ক্রমে সহজ হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত হলে ডাক্তারের কাছে সরাসরি উপস্থিত না হয়ে ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ফি পরিশোধ করে ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করা যায়। যেকোনো ধরনের শারীরিক সমস্যায় ঘরে বসে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে। বিষয়টি সরকারি উদ্যোগে সর্বজনীন হয়ে উঠলে এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ডিজিটাল বাংলাদেশ।

কৃষিক্ষেত্রে : বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ জন লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে কৃষিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। বিজ্ঞানের বদৌলতে উদ্ভাবিত হয়েছে উন্নত জাতের বীজ, পরিবেশ বাবন্ধব সার ও উচ্চ ফলনশীল প্রজাতির শস্য। অনাবৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাও উদ্ভাবিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকসমাজ অধিকাংশ নিরক্ষর হওয়ার কারণে সবকিছুর সফল ব্যবহার করতে পারছে না। তাই কৃষকদের যথার্থ প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত করে তুলতে পারলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওয়েভসাইট থেকে নানা বিষয় জেনে নিয়ে তা কাজে লাগাতে পারে। তাহলে এক্ষেত্রেও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারে।

অফিস-আদালতে : বাংলাদেশের অধিকাংশ অফিস-আদালতে কাজের গতি অত্যন্ত মন্থর এবং সর্বক্ষেত্রে ওঁৎ পেতে আছে দুর্নীতির কালো থাবা। অফিসগুলোতে সি সি ক্যামেরা স্থাপন করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের আওতায় এনে একস্থানে বসে প্রশাসনকে গতিশীল, কর্মমুখি ও দুর্নীতিমুক্ত করা যায়। এ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে চালু করা হলে কেউ আর অফিসে বসে কাজ রেখে আরামপ্রিয়-মগ্ন হবে না এবং ঘুষ-দুর্নীতির সন্ধানে ব্যস্ত রাখবে না নিজেকে। তখনই কুশাসনের পরিবর্তে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং গড়ে উঠবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।

নিরাপত্তা বিধানে : নিরাপত্তা সর্বক্ষেত্রেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে জাতির কোনো নিরাপত্তা নেই সে জাতি কখনোই উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। এক্ষেত্রে সি সি ক্যামেরা স্থাপন ও ইন্টারনেটের সাথে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সংযোগ সাধন করে নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব। কেননা, দুষ্কৃতিকারীরা কোনো অঘটন ঘটিয়ে সাময়িকভাবে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে ক্যামেরার বদৌলতে ধরা পড়তে বাধ্য। এর জন্য যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তবে অন্যরাও এ কাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবে। নিশ্চিত হবে জাতির নিরাপত্তা। আর জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই গতিশীল হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।

ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে : ক্রয়-বিক্রয় মানুষের জীবনে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনার জন্য প্রতিদিনই আমাদের হাটে বাজারে বা কোনো শপিংমলে যেতে হয়। কম্পিউটার নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটানো হলে ঘরে বসে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে এবং বর্তমানে সীমিত আকারে তা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পছন্দ করা, দাম-দস্তুর করা এবং অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করে দ্রব্যসামগ্রী ঘরে বসে পেয়ে যাওয়া সবই সম্ভব। শুধু দেশই নয়, বিদেশের সাথেও একটি কার্যকর হবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে চালু হলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে : যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা গতিশীল না হলে দেশের সার্বিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। বর্তমানে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাহায্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেককিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিশেষ করে আকাশ পথ এখন কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন গ্রহে রকেট উৎক্ষেপণ করা হলে যোগাযোগ থাকছে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে। নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সমুদ্র পথ। মুহূর্তের মধ্যে একদেশের সাথে আরেক দেশের যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা দেশকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা যায়।

প্রকাশনার ক্ষেত্রে : প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনেক আগেই কম্পিউটার সিস্টেম চালু হয়েছে আমাদের দেশে। আগে যে বইটি ছেপে বের হতে দু মাস সময় লাগত, বর্তমানে তা দু দিনেই সম্ভব। বাংলাদেশের কোনো বাংলা বই বিদেশ থেকে প্রকাশ করতে চাইলে এখন আর কোনো সমস্যাই নেই। সবকিছু ফাইনাল করে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা নির্ধারিত দেশে পাঠিয়ে দেওয়া যায় এবং সে দেশের কোনো বই এ পদ্ধতিতে নিয়ে এসে আমাদের দেশে দ্রুত গতিতে প্রকাশ করা যায়।

সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে : সংবাদপত্রে ক্ষেত্রে কম্পিউটার এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি সংবাদপত্র একই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই এখন আর ঢাকা থেকে যানবাহনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী বা সিলেটে পত্রিকা পাঠাতে হচ্ছে না। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা কার্যকরী হচ্ছে। আবার বিদেশি পত্রিকাগুলো আমরা পড়তে পারছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে। অনেক আগের পত্রিকাও খুঁজে বের করে নেওয়া যাচ্ছে ওয়েবসাইট থেকে।

বিনোদনের ক্ষেত্রে : বিনোদনের ক্ষেত্রে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খেলাধুলা, সিনেমা ইত্যাদি থেকে শুরু করে নানা ধরনের আনন্দ উপভোগ করা যাচ্ছে কম্পিউটারের মাধ্যমে। খেলা যাচ্ছে নানা ধরনের গেম। ইন্টারনেটের সাহায্যে অন্য কোনো দেশে চলমান খেলার ফলাফল মুহূর্তের মধ্যেই জানা যাচ্ছে।

ব্যাংক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে : কম্পিউটার সিস্টেম ব্যাংক ব্যবস্থাকে গতিশীল করে তুলেছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংকে চালু হয়েছে অনলাইন সিস্টেম। এখন আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা দূর দূরান্তের কোনো জেলায় নগদ টাকা বহন করে নিয়ে যেতে হয় না। কম্পিউটারের সাহায্যে অনলাইন ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে তা সমাধা করা যায় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। একজনের হিসাব থেকে অন্য কারও হিসেবে মুহূর্তের মধ্যে টাকা পাঠানো যায়। সকল ব্যাংক এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে গড়ে উঠবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।

অনলাইন তথ্য কেন্দ্র স্থাপন : বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্যসেবা জনসাধারণের দোর-গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব অনলাইন তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। এসব তথ্যকেন্দ্র থেকে মানুষ বিভিন্ন ডাটা বা তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। জানতে পারবে সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা ও অবস্থান। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন প্রতিটি উপজেলায় সার্ভার স্টেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এ সার্ভার স্টেশন চালু হলে ভোটাররা তাদের নিজ উপজেলায় বসে নতুন ভোটার হওয়া, ভুল সংশোধন, পরিবর্তনসহ যাবতীয় তথ্য আপডেট করতে পারবে। অন্যান্য সেক্টরেও এ ধরনের সার্ভার স্টেশন চালু হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ওঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে।

উপসংহার : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। দেশটিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হলে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আর উন্নয়ন ঘটাতে হলে কাজের কোনো বিকল্প নেই। কাজের মধ্যদিয়েই ভালোবাসতে হবে দেশকে। প্রশাসনকে করে তুলতে হবে কার্যকর ও গতিশীল। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।

একই রচনা অন্য বই থেকে সংগ্রহ করে আবার দেয়া হলো

ভূমিকা : ‘ডিটিজাল বাংলাদেশ’ বর্তমান সময়ে রাজনীতি, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের বহুল ব্যবহৃত ও বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। ২০২১ সালে পালিত হবে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী। তাই, বাংলাদেশে এ সময়ের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। উন্নত দেশসমূহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্যে এটি একটি সময়োচিত পদক্ষেপ। পৃথিবী ধীরে ধীরে ডিজিটাল পৃথিবীতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সকল জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশকেও এর থেকে বাইরে থাকলে চলবে না। কিন্তু একটি দেশকে ডিজিটাল দেশে তৈরি করার স্বপ্ন দেখা যতই সহজ হোক না কেন তা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর অর্থ : ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কী এ বিষয়কে বুঝতে হলে আমাদের আগেই জানতে হবে একটি দেশ কীভাবে ডিজিটাল দেশে পরিণত হতে পারে। একটি দেশকে তখনই ডিজিটাল দেশ (Digital Country) বলা যাবে যখন তা ‘ই-স্টেট’ (e-state)-এ পরিণত হবে। অর্থাৎ ঐ দেশের যাবতীয় কার্যাবলি যেমন : সরকার ব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি প্রভৃতি কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। তাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে তখনই ডিজিটাল বাংলাদেশ বলবো যখন উপরি-উক্ত বিষয়গুলো যথাযথ অনুসরণ করা হবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর নির্বাচনী ইশতেহারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। ফলে একটি বিশাল সংখ্যক তরুণ ভোটার তাদেরকে ভোট দিয়েছে। এর ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এখন যদি সরকার বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে তবে বাংলাদেশের মানুষের জন্যে তা স্বপ্ন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অবশ্য ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দল (বিএনপি) বা উভয়ই তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি (Information Communication Technology বা সংক্ষেপে ICT) উন্নয়নকে মৌলিক ইস্যু হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছে।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি : সাধারণভাবে বলতে গেলে একটি ডিজিটাল সমাজ নিশ্চিত করবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে পর্যাপ্ত অনলাইন প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত হবে। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ নিশ্চয়তা দেবে দ্রুত ও কার্যকর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি সুশাসিত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। এক্ষেত্রে শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো মূলভিত্তি। কঠিন বাস্তবতাকে অতিক্রম করে বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলতে গেলে এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেমন :

ক. বিদ্যুৎ ঘাটতি : ২০১১ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় বাংলাদেশকে ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার ক্ষেত্রে দৈনিক ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির মুখোমুখি হতে হয়। একথা বলে রাখতে হবে যে, একটি পরিপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো গড়ে ওঠার জন্যে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন একান্ত প্রয়োজন।

খ. নেটওয়ার্ক-কাঠামো : ঢাকার বাইরে এখন পর্যন্ত খুবই কমসংখ্যাক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক কাঠামো উন্নয়নের ধারায় আসতে পেরেছে। ঢাকা শহরের বাইরের কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করে তথ্য পাওয়া গেছে যে, বেশির ভাগ LAN ঢাকা কেন্দ্রিক। এই পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পার্থক্যকে প্রতীয়মান করে।

গ. ইন্টারনেট ব্যবহার : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের জন্যে একটি দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা অতি রূঢ়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার হারে বাংলাদেশের অবস্থান সব চেয়ে নিচুতে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান (ITU, ২০০৭) থেকে জানা যায় আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হার মাত্র ০.৩% যেখানে পাকিস্তান ও ভারতে যথাক্রমে ৭.৩% এবং ৫.৩%।

ঘ. ইংরেজি শিক্ষার হার : বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ইংরেজিতে শিক্ষিতের হার এক শতাংশের কম যেখানে ভরত ও পাকিস্তানে এর পরিমাণ যথাক্রমে ৬০ এবং ২০ শতাংশ। মূলত ইংরেজি ভাষা ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করছে। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারি নি। এজন্যেই আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন করতে ইংরেজি শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

ঙ. সমুদ্রের তলদেশের সাবমেরিন ক্যাবল : ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশের সেঙ্গ বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সুপার হাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমুদ্র তলদেশের সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে। কিন্তু একটি মাত্র সাবমেরিন ক্যাবল প্রায়শই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

এছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। তবে উপরি-উক্ত বিষয়গুলো নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন ও বাস্তবতা : বিশ্বায়ন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বলতে গেলে বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি দ্রুত প্রসারের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহির্বিশ্বে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আজ তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহার ও ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ স্থাপন। এটি বাংলাদেশের যোগাযোগ মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা থেকে অনেকখানি দূরে। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ SEA-ME-WE4 সাবমেরিন ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে শহরের কিছু উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। এর একটা বিশেষ অংশ আবার ফ্যাশন ও বিনোদনের খাতিরে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। তবে বেশির ভাগ জনগণই ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে দূরে আছে। উচ্চ মূল্যে যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয় তবে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপে গড়ার যে স্বপ্ন তা স্বপ্নই থেকে যাবে, বাস্তবে রূপান্তরিত হবে না।

ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ : ডিজিটাল বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি চলমান প্রক্রিয়া। যারা ভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও একটি নির্দিষ্ট বাজেটে কাজটি করা সম্ভব, তারা বোকার রাজ্যে বাস করছে। এই বিশাল কর্মপদ্ধতি চালানোর জন্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করতে গেলে আমাদের উন্নয়নের একটি বিজ্ঞানসম্মত নকশা তৈরি করতে হবে। এ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই ‘e-readiness’ প্লান তৈরি করে তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শী মানবশক্তি তৈরি করতে হবে। ইন্টারনেট কাঠামোর উন্নয়ন ও ইন্টারনেটের ব্যয় সাধারণের সীমার মধ্যে এনে সকল জনগণের জন্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি কাজে ইন্টারনেটের ব্যবহার করে স্বচ্ছতা আনা ইত্যাদি বাংলাদেশকে ডিজিটালায়নে সহযোগিতা করবে। এ জন্যে গনগণকে পরিবর্তনশীল মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে এবং সরকারি রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিরোধীদলসমূহকেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। গ্রাম ও শহর অঞ্চলের মধ্যে একটি ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত ও সহজলভ্য করতে হবে।

উপসংহার : বর্তমান পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবী। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। এ স্বপ্নকেই ধারণ করছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের স্বাধীন হওয়া আমাদের এ মাতৃভূমি ২০২১ সালে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ পালন করবে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে- এটি সকলেরই প্রত্যাশা। তবে এ প্রত্যাশাকে বাস্তবায়ন করা সহজ নয়, যা রীতিমতো একটি যুদ্ধ। নানারকম প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এ সময়ের মধ্যেই আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির এ যুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করতেই হবে।

 

 

রচনা : বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন

রচনা : বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন 

 

রচনা : বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন 

 

বিশ শতকের চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 

“আজও আশা করে আছি পরিত্রাণ কর্তা আসবে সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে চরম আশ্বাসের কথা শোনাবে পূর্ব দিগন্ত থেকেই। ”

বাংলার ভাগ্যাকাশে সেই ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু। আজীবন মাতৃভাষা প্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্যদৃষ্টান্ত। 

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে।

৬-৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। এ সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, 

“পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া ইউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।”

এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন। তিনি এই মজলিসকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহুকাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্বদান করেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে সমকালীন রাজনীতিবিদ সহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন সহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারের দ্বিতীয় দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল’। পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। পাকিস্তান সৃষ্টির তিন-চার মাসের মধ্যেই পুস্তিকাটির প্রকাশনা ও প্রচার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য পাকিস্তান নামের স্বপ্ন সম্পৃক্ত মােহভঙ্গের সূচনার প্রমাণ বহন করে।

১৫০নং মােগলটুলীর 'ওয়ার্কার্স ক্যাম্প' ছিল সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলনকেন্দ্র। ওয়ার্কার্স ক্যাম্প কর্মীরা বাংলা ভাষাসহ পাকিস্তানের অন্যান্য বৈষম্যমূলক দিকগুলাে জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের সপক্ষের কর্মীবাহিনী এখানে নিয়মিত জমায়েত হতাে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হতাে। শেখ মুজিব, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন এই ক্যাম্পের প্রাণশক্তি। সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও মােগলটুলী বিরােধী রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিব, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিনের মতাে নেতারা প্রথমে মােগলটুলীতেই জমায়েত হতেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়ােগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।

২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। তিনি সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আন্দোলনে শরিক হন। ২ মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলাের সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দুজন করে প্রতিনিধি দান করে। এ পরিষদের আহ্বায়ক মনােনীত হন শামসুল আলম। এ পরিষদ গঠনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ছিলেন।

১১ মার্চ ১৯৪৮ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে শেখ মুজিব নেতৃত্বদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচিতে তিনি এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, এ হরতাল ও কর্মসূচি তার জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত করে। ১১ মার্চের হরতাল সফল করতে ১ মার্চ ১৯৪৮ প্রচার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিবৃতিতে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন। জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ বিবৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। ১১ মার্চের গ্রেপ্তার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ১১ মার্চের গুরুত্ব এবং গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন,


রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকার সময় আমি গ্রেপ্তার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে।”

১৫ মার্চ ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ-এর সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনকর্মী ও রাজবন্দিদের চুক্তিটি দেখানাে ও অনুমােদন নেওয়া হয়। অনুমােদনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। কারাবন্দি অন্যদের সঙ্গে শেখ মুজিব চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমােদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসি চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মােতাবেক শেখ মুজিব অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। এই চুক্তির ফলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার এ দেশবাসীর কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ১৫ মার্চ আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে মুক্তিদানের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি শুরু করে। এতে বঙ্গবন্ধু ক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।

১৬ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন। ১৭ তারিখে দেশব্যাপী শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ঐ দিনের ধর্মঘট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয়সম্পন্ন এবং অসমসাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্রসমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রােত সম্পর্কে যাঁরা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্র নেতাদের মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ার বেলায় অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেপ্তার হন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসেও নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন এবং প্রয়ােজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, যেমন- আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামারুজ্জামান, আব্দুল মমিন তারা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী একুশকে নিয়ে ‘কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন:

“শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে। ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।”

জাতীয় নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ভাষা-আন্দোলনের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। তার এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারতাে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার এই মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর সমর্থন আদায় করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন,
“সে সময় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাঁকে একটি বিবৃতি দিতে বলি।”

 
বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর দরদ অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলে শহীদ সােহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিটি ২৯ জুন ১৯৫২ ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ (ইত্তেফাক ১৯৪৯-৫৩ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে থাকলেও ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে এই পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন,
“বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তাে।”

 
বঙ্গবন্ধুর মতাে দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লেখা ভাষণ পাঠ করেন কামরুদ্দীন আহমদ। এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে ছেড়ে যাননি। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সে দিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরােভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে ঘােষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও তিনি বাংলা ভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি ও কথাগুলাে আরাে বার্ধিত উচ্চারণে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন বিকাশে ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের সফল, সাধক ও যােগ্য নেতা ছিলেন বলেই ভাষা সমস্যার ভার তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল। এই মহান নেতা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ।

১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬ অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। একই সালের ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে বলেছিলেন,
“পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে।”
পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লােকই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
“রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনাে ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হােক।”
১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়,
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না।”

১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল নায়ক ও স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন,


“বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা-আন্দোলনেরই সুদূরপ্রসারী ফল।”
এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মহান সুপতির ভূমিকা পালন করে আমাদের একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশের সুযােগ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদান ঐতিহাসিক প্রয়োজন স্বীকার করতে হবে।

 

রচনা : শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু

 

রচনা : শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু

 

 

রচনা : শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু 

যদি রাত পোহালেই শোনা যেতো

বঙ্গবন্ধু মরে নাই,

যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো

বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই,

তবে বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা

আমরা ফিরে পেতাম জাতির পিতা।

হাজার বছরের ইতিহাসে ‘শেখ মুজিব’ নামটি শ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে আসীন হয়ে আছে- এ জাতির প্রতি তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য। বাঙালি জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়েছেন। চিরকাল বাঙালি জাতি তাঁর এই অবদানকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

পরিচয় : ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ, মঙ্গলবার রাত ৮টায় পৃথিবীতে আগমন ঘটে এক মহান ব্যক্তির। ঐ দিন অবিভক্ত ভারতবর্ষের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ থানায় (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) পাঠগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে যে শিশু পরবর্তীতে সেই হয়ে উঠে পৃথিবীর সেরাদের একজন এবং বাঙালীদের আলোর দিশারী, স্বাধীনতার পথ প্রদর্শক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালিদের প্রাণপ্রিয় অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছোট বেলায় বাবা মা আদর করে ডাকতেন খোকা। ভালো নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান। মাতা, সায়েরা খাতুন। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন তিনি। ছিমছাম, শারীরিক গঠন ও দীর্ঘাদেহী। পথ ঘাট শান্ত ছায়া নিভৃত পল্লীতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সুশ্রী চেহারার অধিকারী এই বালকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় ১০ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে গিমাডাঙ্গা মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে। তারপর তাঁদের বদলাতে হয়েছে একাধিক পাঠশালা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়, মিশন স্কুলে ছাত্রদের সভাকে সামনে রেখে এসডিও ১৪৪ ধারা জারী করে সেই সভা বন্ধ করে দেন। অগত্যা ছাত্ররা সমবেত হয়ে মসজিদে গিয়ে সভা করে এবং শেখ মুজিবুর দাঁড়িয়ে দুই-একটি কথা বলতেই তাঁকে গ্রেফতার করে সেকেন্ড কোর্টে হাজির করে দুই ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ ও চাপে শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকেই তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। এটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম গ্রেফতার। ১৯৩৮ সালে (১৮ বছর বয়সে) বেগম ফজিলাতুন্নেসা রেনুর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে দাম্পত্য জীবনে তিন পুত্র ও দুই কন্যার পিতা হন।

তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন : ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে বাংলোতে ফেরার পথে তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে এক ছাত্র অকপটে বলে যায় ছাত্রাবাসের ছাঁদ চুইয়ে পানি পড়ে ছাত্রদের বইপত্র নষ্ট হওয়ার কথা বলে যায়। তৎক্ষনাৎ প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১২০০ (বার শত টাকা) মঞ্জুর করেন এবং স্কুলের ছাদ মেরামতের নির্দেশ দেন। হোসেন সোহরাওয়ার্দী এই ছাত্রের সৎ সাহস ও নির্ভীকতায় অভিভুত হয়ে পিয়ন মারফত বাংলোয় খবর দিয়ে এনে নানা রকম আলোচনা করেন এবং তাঁর কথায় সন্তুষ্ট হন। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে রাজনীতির গুরু মানতেন। ১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকায় উর্ত্তীন হন শেখ মুজিব। পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) আই এ ক্লাস ভর্তি হন। তখন থেকেই মুসলিমলীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রদেশিক বেঙ্গল মুসলিমলীগের কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকেই ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর সদস্য হন এবং ঐ বৎসর দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে তিনি জনসেবা করেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী – হাসিম গ্রুপের সাথে তিনি ছিলেন সক্রিয় ভাবে যুক্ত। ১৯৪৬ সালের ভারতবর্ষের অন্তবর্তী সরকারের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিমলীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বঙ্গবন্ধু নিজেও সাংবাদিকতা করেছেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার পূর্ব-বাংলা প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার পর তিনি আবার গ্রেফতার হন। তাই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবন আর সমাপ্ত হয়নি।

১৯৪৯ সালের ২১শে জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব। এ বছরের ২৩ জুন ঢাকা রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে গঠিত হয়। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। একজন রাজবন্দী হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন। কারাবন্দী থেকেই শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে। ১৯৪৯ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অক্টোবরে আর্মানীটোলা থেকে এক বিশাল ভুখা মিছিল থেকেই গ্রেফতার হলেন মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিব। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে (শেখ মুজিব তখনও জেলে) ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশের পরিস্থিতি তখন টালমাটাল। ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনটিকে ঘোষণা করা হলো “ভাষা দিবস” হিসেবে। মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করলে গভীর রাতে কিছু ছাত্র নেতা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিলে শেখ মুজিবুর কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তে সমর্থন জানান এবং বরিশালের মহিউদ্দিন আহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর শহীদ হন। কারাগারে স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। মাওলানা ভাসানী স্বীয় ক্ষমতাবলে শেখ মুজিবকে আওয়ামী মুসলিমলীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯৫৬ সালে মহাচীনের রাজধানী বেইজিং নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। ১৯৫৩ সালে ৯ জুলাই তিনি পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। স্বল্প সময়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান এ অঞ্চলে শিল্পের বিকাশে অনেক আইনি কাঠামো প্রণয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেখ মুজিব আওয়ামীলীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সোহরাওয়ার্দী তখন রাজনৈতিক দলসমূহ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না এবং এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে ত্যাগের ঘোষণা দেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে বাংলাদেশকে বিমাতাসূলভ আচরণ করে অরক্ষিত রাখার প্রতিবাদে এই বাংলার সাধারণ মানুষ রাগে, দুঃখে ফেটে পড়েন। এই বিমাতাসূলভ আচরনের প্রতিবাদে ৬৯-এর ২৩শে ফেব্রুয়ারি প্রায় ১০ লক্ষ ছাত্র-জনতার উদ্যোগে রেসকোর্স ময়দান বর্তমান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় এ বাংলার সাধারণ মানুষের পক্ষে তৎকালীন ডাকসুর নেতৃত্বে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন। কার মাথায় প্রথমে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি এসেছিল। কলামিস্ট ওবায়দুল কাদের বলেন (বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি ও বর্তমান মন্ত্রী) ১৯৮৭ সালে ৩১শে জুলাই দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লিখেন শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হন লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১৯৬৯ সালে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ শাখার উদ্যোগে “প্রতিধ্বনি” নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করতো। সে পত্রিকার ১৯৬৭ সালের ৩ নভেম্বরের সংখ্যায় ছাত্রলীগের নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ‘আজব দেশ’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেন। এ লেখায় তিনি নিজের ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন ‘সারথী’ নামে। লেখাটার শেষ দিকে ‘বঙ্গশার্দুল’ শেখ মুজিবের পাশে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন। এই পত্রিকায় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর একই সংখ্যায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবিত পূর্ব-বাংলার ‘মুক্তিসনদ’ ৬ দফা শিরোনাম হয়ে আসে। তখন একটি সাময়িকীতে ব্যবহৃত ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ঢাকার ছাত্র মহলের একাংশ ছাড়া অন্য কারো নজর কাড়েনি। শব্দটি গুরুত্ব পায় যখন জাগ্রত বাঙ্গালি জাতির জাগরণের সব শ্রোতধারা এক মোহনায় একাকার, যখন গনমোহন মুজিব বিদ্রোহী বাংলা মুকুটহীন সম্রাট। তখনই মুজিবের জন্য যুৎসই এ খেতাবটি তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতৃত্বের পছন্দ হয়। চট্টগ্রামের সন্তান রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক তখন ঢাকা কলেজের তৎকালীন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এ প্রসঙ্গে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক বলেন, তিনি ও তাঁর বন্ধু শেখ কামাল (বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র) ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের মুখপত্র হিসেবে ‘প্রতিধ্বনি’ নামে এই বুলেটিন প্রকাশ করেন। ‘আজব দেশ’ নামক নিবন্ধে ১৯৬৮ সালের ৩ নভেম্বর তারিখের সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি এই নাম ব্যবহার করেন। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমানের সংবর্ধনায় (১৯৬৯ এর ২৩শে ফেব্রুয়ারি) ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করার পর সেটি বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এই অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৬ সালে ৭ই জুন ১১ দফাকে ৬-দফা দাবীতে রূপান্তরিত করতে জীবন দিতে জানে- গোলামী করতে জানে না। এরপর তাঁকে আগরতলা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। তিনি ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ট আসনে আওয়ামীলীগকে বিজয়ী করেন। এই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে তাঁর দল আওয়ামীলীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করার পরেও কিন্তু পাকিস্তানী দালাল ভূট্টোর চক্রান্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে গড়িমসি করেন। যার ফলে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং এই জনসভায় তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা আসে- “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” এবং একই বছর ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন এবং ঘোষণা দেওয়ার পরই তিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে তাঁর পক্ষে তৎকালীন মেজর জিয়াউল রহমান সহ অনেকে বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে এই স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেন। পরবর্তী ১৭ই এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সরকার গঠন করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই বাংলার মানুষ পায় চির মুক্তির স্বাদ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ধীরে ধীরে মুজিবুর বাঙ্গালি জাতির হৃদয়ের ফ্রেমে বঙ্গবন্ধু নামে আবির্ভাব ঘটে। বিশ্বের তিন নেতার তিন বিষয় বেশ আলোচিত, ইন্দিরার শাসন, ইয়াহিয়ার শোষণ আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধ পরবর্তী সময় শুরু করেন আরেকটি নতুন যুদ্ধ, একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ, অনাচারে-অনাহারে ম্রিয়মান একটি রাষ্ট্রকে পূনরায় জীবন দিতে ছুটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, বিশ্বের এক রাষ্ট্র থেকে আরেক রাষ্ট্র। তিনি প্রায়ই বলতেন, সাত কোটি বাঙালি নিয়েই আমার পরিবার।

বিলাসিতা তাঁর জীবনকে ছুঁতে পারে নায় -এমনকি সরকারী সুযোগ-সুবিধাদি গ্রহণ না করে গণভবনের আয়েশী জীবন ত্যাগ করে নিজের গড়া সেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীতেই বসবাস করতেন। সেখানে নিরাপত্তা ছিল একেবারেই শিথিল। এ কারণেই ঘাতকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত করার সুযোগ পান। ঘাতকদের নির্মম বুলেট তাঁকে বাঁচতে দিয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোরে কতিপয় বিপদগামী সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের হাতে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে কারাগারে কেটেছে ১২ বছর মতান্তরে ১৪ বছর। তবে অপচয় হতে দেননি সময়টা। নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন-এর মতো মৌলিক বইসমূহ/।

ইতিহাসের রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, জার্মানির বিসমার্ক, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, চীনের মাও সেতুং, মিশরের জামাল আবদুল নাছের, ভারত বলতে যেমন মহাত্মা গান্ধী, পাকিস্তান বলতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আমেরিকা বলতে যেমন জর্জ ওয়াশিংটনের নাম, দক্ষিণ আফ্রিকা বলতে নেলসন ম্যান্ডেলা, মালয়েশিয়া বলতে যেমন মাহাথির মোহাম্মদের নাম স্মরণ করা হয় ঠিক তেমনি বাংলাদেশের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে যে নামটি মানসপটে ভেসে আসে তা হলো- শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সুচনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর অনুসারী হিসাবে রাজনীতি শুরু করলেও সুভাস চন্দ্রের রাজনৈতিক দর্শনই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। ১৯৪২ সালে ছাত্র থাকাকালে তিনি সুভাস চন্দ্রের নেতৃত্বে পরিচালিত কলকাতায় ইংরেজদের নির্মিত হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙ্গার আন্দোলনে মিছিলে যোগ গিয়েছিলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণকে বলেছেন একটি মহাকাব্য। আর সেই মহাকব্যের মহাকবি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় শেখ মুজিবকে নাম দিয়েছিলেন ‘এ পোয়েট অব পলিটিক্স’। কবি নজরুল ইসলামের ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি পাঠ করে নেতাজী সুভাস চন্দ্র বলেছিলেন,

“রাজনীতি অথবা রাজনৈতিক সংগ্রামে কবিতা অনেক সময় অস্ত্রের চাইতেও শক্তিশালী হাতিয়ার।”

যে দেশের মানুষ তাদের জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও জনকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং সম্মান প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ তাদের অত্যন্ত সংকীর্ণ ও নিচু শ্রেণির মানুষ বলেই মনে করে। এক কথায়, সূর্যালোকের মতো সত্য বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক দেশটি সৃষ্ট হতো না। একটি জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জাতির অগ্রগতি ও উন্নতি এবং বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বার্থে নেতৃত্ব যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বই পড়ার দরকার নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রামী জীবনটাই আমাদের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বই। তিনি ছিলেন, বিশ্বের বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষকে কাছে টানার ক্ষমতা ছিল অসীম। দেশ ও জাতির সঙ্গে মিশে থাকা চেতনার নাম বঙ্গবন্ধু। আমরা জানি একটি বিশাল দেশের পাশে একটি ছোট দেশ কদাচিৎ স্বাধীন। এর একমাত্র ব্যতিক্রম দেশ কিউবা। বিশাল আমেরিকার পেটের মধ্যে অবস্থান করেও স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে আছে কিউবা। এর একমাত্র কারণ তাদের মহান নেতা ফিদেল ক্যাষ্ট্র্যে। তিনি বলেছিলেন,

“আমি হিমালয় দেখেনি তবে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি”

মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদেরও একজন ফিদেল ক্যাষ্ট্র্যে দিয়েছিলেন। যাঁর বিচক্ষণতায় তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে মিত্রবাহিনী চলে গিয়েছিল। প্রতিবেশী বিশাল দেশ ভারতের সাথে ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির’ মাধ্যমে গঙ্গার পানি বন্টন স্থলসীমানা বিরোধসহ অসংখ্য অমীমাংসিত সমস্যার সম্মানজনক সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল।

শেখ মুজিব কেবল বঙ্গবন্ধু নন, বিশ্ববন্ধুও ছিলেন বলেই আমরা ছোট দেশ হয়েও ছোট ছিলাম না। একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে বাংলা শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। বাংলা শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহ্‌রাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন যে,

“আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ বদলে ‘বাংলাদেশ’ ডাকা হবে।”

মুজিব তাঁর অন্তর্বর্তী সংসদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ঘোষণা করেন যা মুজিববাদ নামেও পরিচিত। মুজিব শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানী রাষ্ট্রীয়করণ করেন এবং ভূমি ও মূলধন বাজেয়াপ্ত করে ভূমি পূনর্বণ্টনের মাধ্যমে কৃষকদের সাহায্যের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কৃষকদের পরম বন্ধু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর পূনর্বাসনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি’র বাংলা রেডিও সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বের যে জরিপ চালানো হয়, তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন। যদি আপনি বাঙালি হোন, আপনাকে যেমন রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে জানতে হবে, ঠিক তেমিন অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকেও জানতে হবে।

 

রচনা : একুশের চেতনা, একুশ আমার অহংকার,জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা ও তাৎপর্য

 

রচনা : একুশের চেতনা

 

↬ একুশে ফেব্রুয়ারি ও একুশের চেতনা

↬ একুশ আমার অহংকার

↬ একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য

↬ জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা ও তাৎপর্য

↬ জাতী গঠনে একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব

ভূমিকা : বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের মুখের ভাষার সতীত্ব রক্ষায় বাংলার নির্মম-মৃত্যু-ভয় নির্লিপ্ত দুর্জয় সন্তানেরা আপন বুকের রক্তে পীচ-ঢালা কালো রাস্তাকে রঞ্জিত করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এই ভাভা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্দমনীয় সংকল্পের গভীরে প্রোথিত শেকড় রস সঞ্চার করে, দেশকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে গেছে। অমর একুশে তাই আমাদের জাতীয় জীবনে বেদনাবিজড়িত এক গৌরবগাথা। প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের বেদনা-বিধুর স্মৃতি ও সংগ্রামী চেতনার অমিয় ধারাকে বহন করে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের দ্বারে ফিরে আসে। জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাবার ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য অপরিসীম। একুশের এই তাৎপর্যের প্রতি আলোকপাত করতে গিয়ে কবি শামসুর রহমান বলেছেন-

‘আবার ফুটেছে দ্যাখ কৃষ্ণচূড়া থরে থরে, শহরের পথে

কেবল নিবিড় হয়ে কখনও মিছিলে কখনও বা

একা হেঁটে যেতে মনে হয়, ফুল নয় ওরা

শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিত-গল্পে ভরপুর

একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।’

২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহাসিক দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শুধু আমাদের মাতৃভাষা দিবস নয়। প্রতি বছর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সারা বিশ্বে পালিত হবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে।

একুশের ইতিহাস :

‘মাগো ওরা বলে,

সবার কথা কেড়ে নেবে

তোমার কোলে শুয়ে শুনতে দেবে না।

বলো মা, তাই কি হয়?

----- আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।

ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। অতঃপর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়াদী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন : “Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan”. এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সাথে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয়-অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেন নি। ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এই ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি প্রদান করলে ছাত্র-জনতার মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধি-নিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে। মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এতে সারা বাংলায় প্রতিবাদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সমগ্র জাতি সম্মিলিতভাবে গর্জে ওঠে সিংহের মত। পরিশেষে, শাসকগোষ্ঠী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়।

একুশের চেতনায় স্বাধীনতার বীজমন্ত্র : একুশের আন্দোলন যদিও একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল কিন্তু তা কেবল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। সে-আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও। বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রথম সফল সংগ্রাম হিসেবে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের ক্ষেত্রেই একুশের চেতনা বাঙালি জনমনে মাইল ফলক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় একুশের চেতনায় বাঙালি সাধারণের আত্মজাগরণ ঘটেছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর থেকে বাংলার জনসাধারণ বুঝতে পেরেছিল মিষ্টি কথায় অধিকার আদায় হয় না। এর জন্য রক্ত ঝরাতে হয়। পরবর্তীকালে এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ বাংলার জনগণের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।

তাৎপর্যের উত্তরণ ও একুশের চেতনা :

“একুশ ভাষার প্রাণ

একুশ করেছে দান

একুশ মোদের পাথেয়

একুশকে করো নাকো হেয়।”

বাঙালি জাতির আত্মোপলব্ধির উত্তরণ ঘটে ঊনিশ’শ বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের মাধ্যমে।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ এনামূল হকের মতে

“একুশে ফেব্রুয়ারি কোন বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তিথি নয়, একটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ। যেন সজীব ‘লাভা স্রাবক আগ্নেগিরি’, কখনও অন্তর্দাহে গর্জন করছে, আর কখনও চারিদিকে অগ্নি ছড়াচ্ছে। সত্যি এ ইতিহাস মৃত নয়, একেবারে জীবন্ত।”

বাড়ালি জাতীর চেতনার উপলব্ধির ক্রমবিকাশে এখানে এসে গাঢ়তায় রূপ নেয়। সমগ্র জাতি ভাবতে শেখে তার জাতীয় সত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সত্তার কথা।

সাংস্কৃতিক বিকাশের চেতনা : আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিমেয়। একুশ জাতীয় চেতনার মানসপটে নতুন সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম নেয়। সৃষ্টি হয় চেতনাপুষ্ট শিল্প-সাহিত্য। মুনীর চৌধুরী রচিত ‘কবর’ নাটকটি বাঙালি সংস্কৃতি-চেতনার স্বাক্ষরই বহন করে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতে অর্থাৎ ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাজবন্দি মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘কবর’ নাটকটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল রাজবন্দিদের উদ্যোগে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর অনন্য গান :

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’

এই গান একুশেরই ফসল। একুশের প্রথম কবিতা মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। কলকাতায় ‘বাবু কালচার’ কেন্দ্রিক সংস্কৃতিধারার বিপরীতে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বাঙালি জাতীয় সংস্কৃতিধারা বিকাশ লাভ করে একুশের সংগ্রামী চেতনারই মাধ্যমে। এভাবে একুশে উদ্‌যাপন উপলক্ষে প্রতিবছরই একাধিক সংকলন হচ্ছে, ফলে একুশ পরিণত হয়েছে আমাদের জাতীয় উৎসবে।

একুশের চেতনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উদ্‌যাপন করতে গিয়ে তখনকার প্রগতিশীল কর্মীরা কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্নপায়ে প্রভাতফেরী ও সমবেত কণ্ঠে একুশের গান, শহীদদের কবর ও মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেন। সেই থেকে এসব কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দাঁগিয়েছে। এখন এসব আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ১৯৫৪ সালে বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা এবং তারপর থেকে একুশ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রতি বছর অমর একুশের যেসব অনুষ্ঠানমালা এবং বইমেলার আয়োজন করে তার সবকটিই একুশের চেতনার ফল।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে একুশের ভূমিকা অপরিসীম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্ত বৃথা যায় নি। আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত এ সুদীর্ঘপথে লাখো লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এদেশের মাটি। কিন্তু মহান ফেব্রুয়ারি এদেশের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে আপোষহীন সংগ্রাম ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। একুশ হোক জগতের সকল অনৈক্য, সংঘাত ও অশান্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হাতিয়ার। হোক সমুদ্রপথের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতের আশার প্রদীপ, দিক নির্দেশক আলোক বর্তিকা।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


ভূমিকা : কোনো কোনো মহৎ দিন কখনো কখনো জাতীয় জীবনে নিয়ে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা। আমাদের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনি একটি দিন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্মৃতিচিহ্নিত এ দিনটি সংগ্রামের আগুনে জ্বলন্ত, রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এ দিনটি ইতিহাসের একটি বিবর্ণ তারিখ নয়। তা এমন একটি দিন যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে গতিময়, প্রাণবন্ত, তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জন্ম নিয়েছিল ঐ চেতনা। আমাদের জাতীয় জীবনে এ এক অবিনাশী চেতনা। 

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি : জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার এক পর্যায়ে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্য যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা ৭ ভাগ লোকের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলা। বাংলা ভাষার দাবিতে ধূমায়িত হতে থাকে পুঞ্জীভূত ঘোষণা করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলা। বাংলা ভাষার দাবিতে ধূমায়িত হতে থাকে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত জোরালো হয়ে ওঠে ভাষার দাবি। বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল ইস্যু হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের শুরুতেই বাংলা ভাষা আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। ’৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন ও সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমন করার জন্যে ১৪৪ ধারা জারি করে জনসভা, মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম-না-জানা অনেকে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সারা পূর্ব বাংলা। পরদিন সারারাত জেগে শহীদ স্মৃতি স্মরণে গড়া হয় শহীদ মিনার। পুলিশ তা ভেঙে ফেললে আবারও গড়ে ওঠে শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনার একুশের শোক, সংগ্রাম ও শপথের প্রতীক। তা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও জাতিচেতনামূলক আন্দোলনের চালিকাকেন্দ্র হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে। 

একুশের চেতনায় স্বাধীনতার বীজমন্ত্র : একুশের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনের আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বাহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণ-আন্দোলনের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ঐ আন্দোলন। সেদিন বাঙালির আত্মচেতনতার যে উদ্বোধন ঘটেছিল তাই নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রূপ নিয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। একুশের চেতনা পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়। 

একুশের তাৎপর্য : একুশের তাৎপর্য বহুমুখী। একুশের চেতনায় কেবল যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়, বাঙালির জাতীয় চেতনাকেও একুশ স্ফটিক-স্বচ্ছতা দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের ওপর যে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন চালায় তার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় সংগঠিত হতে একুশ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের সচেতন, সক্রিয় ও উদ্বুদ্ধ করেছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে। 

একুশের চেতনা ও জাতিসত্তার স্বরূপ : আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কারেও একুশের অবদান অসামান্য। আমরা জেনেছি আমরা বাঙালি। জেনেছি বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ আমাদের দেশ। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরে আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের ঠিকানা ও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যে লড়াই করেছি। একুশের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা। 

সাংস্কৃতিক বিকাশের চেতনা : আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি যেন হাজার তারের এক বীণা। তাতে কত না সুর, কত না ঝংকার। একুশের এই বীণায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি। একুশের ফসল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনন্য গান : 

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’

এ গান আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে উজ্জীবনী মন্ত্রের প্রেরণা। একুশের চেতনার পথ ধরে আমরা অর্জন করেছি আরো কত দেশাত্মবোধক গান। 

একুশের চেতনা ও সাহিত্য : একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্য-অঙ্গনেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে ফলিয়েছে অজস্র ফসল। একুশের প্রথম কবিতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ এর পর অফুরান সৃষ্টিতে ভরে গেছে আমাদের সাহিত্যের ডালি। একুশের আরেক অনবদ্য ফসল চিরভাস্বর হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের সংকলন- ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। তারপর প্রতিবছর একুশ উদ্‌যাপন উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে অজস্র সংকলন। এভাবে একুশ পরিণত হয়েছে আমাদের জাতীয় উৎসবে। 

একুশের চেতনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উদ্‌যাপন করতে গিয়ে তখনকার প্রগতিশীল কর্মীরা কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্নপদে প্রভাতফেরি, শহীদদের কবরে ও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রভাতফেরিতে সমবেত কণ্ঠে একুশের গান পরিবেশন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেন। সেই থেকে এসব কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এসব আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ। 

একুশের চেতনা ও বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলন : একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতে অর্থাৎ ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাজবন্দি মুনীর চৌধূরীর লেখা বিখ্যাত ‘কবর’ নাটকটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল রাজবন্দিদের উদ্যোগে। এভাবে একুশের চেতনা বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারাকে পরিব্যাপ্ত করেছিল। 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় একুশের চেতনা : একুশের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত অব্যাহত রাখে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটানোর জন্যে তারা নানা অপপ্রয়াস চালায়। তাদের চেষ্টা ছিল বাংলা ও উর্দু মিলে একটা ভাষা তৈরি করা, বাংলা বর্ণমালা তুলে দিয়ে রোমান হরফে বাংলা প্রবর্তন করা ইত্যাদি। পাকিস্তানি আমলে বাংলা সাহিত্যকে জোর করে পাকিস্তানিকরণের চেষ্টাও কম হয় নি। রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের ষড়যন্ত্র, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে বাধা প্রদান, রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধকরণের অপচেষ্টা ও নজরুলের রচনাকে আংশিক ও খণ্ডিতভাবে গ্রহণ ছিল তাদের হীন তৎপরতার অঙ্গ। এসব হীন তৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছে একুশ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলনে একুশ এক অনির্বাণ চেতনা। 

একুশের চেতনা ও বাংলা একাডেমি : একুশের সাংস্কৃতিক চেতনার আর একটি অসামান্য ফসল ১৯৫৪ সালে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা, গবেষণা ও বিকাশে আমাদের জাতীয় জীবনে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য। একুশ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রতি বছর অমর একুশে অনুষ্ঠানমালাসহ যে বইমেলার আয়োজন করে তা আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। 

উপসংহার : আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশ একাধারে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, গৌরবগাথা ও প্রেরণা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ একুশের চেতনারই মহান ফসল। তাই একুশের অবিনশ্বর চেতনা আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। এই চেতনা অম্লান রেখে জাতির সর্বময় কল্যাণ ও অগ্রগতির পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। একুশের চেতনার পতাকা সমুন্নত রাখার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে নতুন প্রজন্মকে।

রচনা : একুশের চেতনা

রচনা : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

 

রচনা : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

Bangabandhu - Apps on Google Play

ভূমিকা : স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের কল্যানের জন্য ব্যয় করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে সংঘবদ্ধ করতে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাই আমরা বাংলাদেশীর হিসেবে জাতির পিতার জীবনী সম্পর্কে জ্ঞঅনার্জন করা অপরিহার্য।

জন্ম ও পরিচয় : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গোপালগঞ্জ বর্তমানে একটি জেলা। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফুর রহমান এবং তাঁর দাদার নাম শেখ আবদুল হামিদ। তাঁর মাতার নাম সাহেরা খাতুন এবং নানার নাম আবদুল মজিদ। তাঁর আকিকার সময় তাঁর নানা আবদুল মজিদ বঙ্গবন্ধুর নাম রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং বলেছিলেন এ নাম জগৎ জোড়া খ্যাত হবে। পিতা-মাতা তাকে আদর করে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন। এবং ভাইবোন ও গ্রামবাসির নিকট তিনি ‘মিয়াভাই’ বলে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে ১৭ই মার্চ সারাদেশে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়।

শৈশব :  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব সম্পর্কে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে বলেছিলেন,

আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে।

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছিলেন,

ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতাম।

শিক্ষাজীবন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয় নিজ গৃহে গৃহশিক্ষকদের হাত ধরে। তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধু আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন। পরবর্তীতে তিনি গিমাডাঙ্গা স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। একবার বর্ষাকালে নৌকা করে স্কুল থেকে ফেরার পথে নৌকাডুবি হলে তাঁকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তিনি ১৯৪২ সালে এন্ট্রাস পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে [বর্তমান আজাদ মওলানা কলেজ] ভর্তি হন। সেখানে তিনি বেকার হোস্টেলে থাকতেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। দেশভাগের পর তিনি ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তিহন। তিনি ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী ছিলেন।

বিবাহ : বিবাহ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে  বলেছিলেন,

আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তেরো বছর হতে পারে। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে, তখন কিছুই বুঝতাম না। রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।

খেলাধুলা প্রিয় : বঙ্গবন্ধু একজন দক্ষ ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন, এমনকি তাঁর পিতাও ফুটবল খেলা পছন্দ করতেন। খেলাধুলা নিয়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে লিখেন -

আমার আব্বার পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুন ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলা খুব পছন্দ করতেন। মধুমতি নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লাহাট যেতেন খেলতে। এদিকে আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন।

বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত : বঙ্গবন্ধু ছোট বেলায় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এ বেপারে তিনি  অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেন-

১৯৩৪ সালে যখন আমি ৭ম শ্রেনীতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। হঠাৎ বেরিবোরি রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। আব্বা আমাকে নিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যান। কলকাতার বড় বড় ডাক্তার শিবপদ ভট্টাপার্য, এ.কে. রায় চৌধুরী আরও অনেককেই দেখান এবং চিকিৎসা করাতে থাকেন।

গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত : বঙ্গবন্ধু ছোট বেলায় চোখের গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন। এই সম্পর্কে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিঁনি বলেন-

১৯৩৬ সালে আবার আমার চক্ষু খারাপ হয়ে পড়ে। গ্লুকোমা নামে একটা রোগ হয়। ডাক্তারদের পরামর্শে আব্বা আবার আমাকে নিয়ে কলকাতায় রওনা হলেন চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার সাহেব আমার চক্ষু অপরেশন করাতে বললেন। অপরেশন করা হলো। আমি ভাল হলাম। তবে কিছুদিন পড়াশুনা বন্ধ রাখতে হবে, চশমা পরতে হবে। তাই ১৯৩৬ সাল খেকেই চশমা পরছি। 

শিক্ষা বিরতি : অসুস্থার কারণে বঙ্গবন্ধু চার বছর লেখাপড়া করতে পারতে পারেন নি। এ সম্পর্কে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর রচিত শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে লিখেন -

স্কুলে পড়তে পড়তে আব্বার বেরিবেরি রোগ হয় এবং চোখ খারাপ হয়ে যায়। ফলে চার বছর লেখাপড়া বন্ধ থাকে। তিনি সুস্থ হবার পর পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন।

মুসলিম সেবা সমিতি : বঙ্গবন্ধুর একজন স্কুল মাস্টার একটা সংগঠন গড়ে তুলেন যার সদস্যরা বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ধান, চাল, টাকা জোগাড় করে গরিব মেধাবী ছেলেদের সাহায্য করতেন। বঙ্গবন্ধু সেই দলের অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেন -

মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন প্রত্যেক মুসলমানের বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাউল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার অন্যান্য খরচ দিতেন।

এছাড়ও তার দানশীলতার বেপারে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে লিখেন -

দাদির কাছে শুনেছি আব্বার জন্য মাসে কয়েকটা ছাতা কিনতে হতো কারণ আর কিছুই নয়। কোন ছেলে গরিব,ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ রোদ বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে, তাদের ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন।

প্রথম বিদ্রোহ : এ সম্পর্কে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে বলেন,

কৈশরেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। একবার যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা গোপালগঞ্জে সফরে যান এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। সেই সময় সাহসী কিশোর শেখ মুজিব তাঁর কাছে স্কুলঘরে বর্ষার পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরেন এবং মেরামত করার অঙ্গীকার আদায় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

রাজনীতিতে অংশগ্রহণ : এ সম্পর্কে শেখ হাসিনা তাঁর শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে লিখেন -

গোপালগঞ্জ স্কুল খেকে ম্যাট্টিক পাস করে তিনি কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। তখন বেকার হোস্টেলে থাকতেন। এই সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দলনে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয়ভাবে। এই সময় থেকেই তাঁর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয়।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন : এ সম্পর্কে শেখ হাসিনা তাঁর শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে লিখেন-

এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রথম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা লগ্নে।

কারা জীবন : ৭ মার্চ ২০১৭, তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জাতীয় সংসদে বলেন, বঙ্গবন্ধু সারা জীবনে মোট ৪৬৮২ দিন কারাভোগ করেন। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমলে ৭ দিন এবং পাকিস্তান আমলে ৪৬৭৫দিন। বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান।

ছাত্রলীগ গঠন : পকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নঈমউদ্দিন আহমেদ মিলে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন।

তিঁনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন-

১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হলো,সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন : ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারন সম্পাদক ছিলেন শামছুল হক এবং বঙ্গবন্ধু ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি। ১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দলটির নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। আওয়ামীলীগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন-

শেষপর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল। শুধু কর্মীরা না, অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামছুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হলো জয়েন্ট সেক্রেটারি।

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করেই বাংলা ও বাঙালিকে পদানত রাখার পরিকল্পনা করে। প্রথমেই আঘাত হানে ভাষার ওপর। তারা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করেন এবং এর প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু আমতলায় সভাপতির হিসেবে ভাষণ প্রদান করেন। এই সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু  তাঁর রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন-

১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারন ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করালাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো।

১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকাকালীন অবস্থায় ভাষার জন্য অণশন শুরু করেন। পরবর্তীতে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি আবার আন্দোলন শুরু করনে।

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন -

আমি সাধারণ সম্পাদক (আওয়ামী মুসলিম লীগের) হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যারা ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম।

যুক্তফ্রন্ট : পকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিমলীগ পকেট সংগঠনে পরিণত হলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেরেবাংলা, ভাষানী ও হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর চারটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়। এই নির্বাচনে প্রথমবারের মত অংশগ্রহণ করেই বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু সর্বকনিষ্ট মন্ত্রী হিসেবে সমবায় ও কৃষিঋণ মন্ত্রণলায়ের দায়িত্ব লাভ করেন।

কারাগার থেকে কারাগারে : ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির চারদিন পর বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। প্রায় ১৪ মাস আটক রাখার পর মুক্তিপান তিনি। তবে আবার জেলগেইট থেকে তাঁকে আটক করা হয়। প্রায় দুই বছর করাগারে থাকেন এসময়। ১৯৬১ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে তিনি মুক্তিপান। ১৯৬২ সালে জননিরাপত্তা আইনে আবার তাঁকে গ্রফতার করা হয়। পরবর্তীতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন প্রকাশিত হলে বঙ্গবন্ধু এর সমালোচনা করেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ জানান।

ঐতিহাসিক ছয় দফা : ছয়দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যকার বৈষম্য এবং পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ঘোষিত কর্মসূচি। তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহের জতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ এতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ছয় দফা দাবির প্রথম দফা ছিল-

‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে’

আগরতলা মামলা : পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মরত ও প্রাক্তন সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা ভারত সরকারের সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা শহরে ভারতীয় পক্ষ ও আসামি পক্ষদের মধ্যে এ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে মামলায় উল্লেখ থাকায় একে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এ মামলা এবং এর প্রতিক্রিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ৩৫ জনকে আসামি করে পাকিস্তান দন্ডবিধির ১২১-ক ধারা এবং ১৩১ ধারায় মামলার শুনানি শুরু হয়। মামলায় শেখ মুজিবকে ১ নম্বর আসামি করা হয় এবং ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং’ নামে মামলাটি পরিচালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

গণঅভ্যুত্থান : ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ, বাঙালির ম্যাগনাকার্টা। ১৯৬৭ সালের ১৬ জুন নির্ভিক সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেনের ইত্তেফাক পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২৩ জুন রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা করে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়। ফলে সারা দেশে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারী ছাত্র সমাজ ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। ৮ জানুয়ারী ৮ টি রাজনৈতিক দল নিয়ে DAC গঠিত হয়। ২০ জানুয়ারী ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। আন্দোলন তীব্রতর হয়। ১৫ ফেব্রয়ারী আগরতলা মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে কারাগারের ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৮ ফেব্রয়ারি ১৯৬৯ তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুজ্জোহা কে হত্যার ফলে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ জানুয়ারী সারা দেশে গণ আন্দোলন হয়।

বঙ্গবন্ধু উপাধিলাভ : গণআন্দোলনের মুখে সরকার ২২ ফেব্রুয়রী ১৯৬৯ তারিখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রেসকোর্সের ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেয়। সভায় তৎকালীন ছাত্রনেতা, ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ লাখো জনতার উপস্থিতিতে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

বাংলাদেশ নামকরণ : ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামীলীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন-

জনগনের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি, আজ হতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ’ হবে।

৭০ এর নির্বাচন : ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহনের সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা, স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’ আর ঘোষণাপত্র ছিল ছয় দফা। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি লাভ করলেও আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় না। এ জন্যই ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক বলা হয়।

অসহযোগ আন্দোলন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল এক ব্যক্তি এক ভোট নীতির প্রথম নির্বাচন। ৩ মার্চ ১৯৭০ সালে আ. স. ম. আবদুর রব বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি প্রদান করেন। এই সমাবেশে বক্তৃতা কালে বঙ্গবন্ধু আসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।

৭ই মার্চের ভাষণ : ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে রোজ শুক্রবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ভাষণ প্রদান করেন। সময় বিকাল ৩ট ২০ মিনিট। শেখহাসিনা বলেন, এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ২৩ মিনিট তবে ১৮-১৯ মিনিট রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করেন এ. এইচ. খন্দকার এবং চিত্র ধারণ করেন আবুল খায়ের এম.এ.নএ.। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫ম তফসিলে জাতির পিতার এ ভাষণ সন্নিবেশিত হয়। এ ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-

আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই।

৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ৪ দফা দাবি তুলে ধরেন। নিচে তা উল্লেখ করা হলো-

(১) প্রথমে মার্শাল-ল উইথড্র করতে হবে।

(২) সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে।

(৩) যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে।

(৪) জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

১৩ নভেম্বর ২০১৭ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ২৬টি বাক্যের বিশ্লেষণ করে “বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : রাজনীতির মহাকাব্য” শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রন্থটি প্রকাশ করে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে “ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারী হেরিটেজ” বা “বিশ্ব প্রামাণ্যের ঐতিহ্য” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৪২৭ টি নথি এতে যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি ইউনেস্কো ঘেষিত ৭৮টি ঐতিহাসিক দলিলের মধ্যে ৭ই মার্চের ভাষণ ৪৮ তম। ইউনেস্কোর এযাবৎ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪২৭টি প্রামান্য ঐতিহ্যের মধ্যে প্রথম অলিখিত ভাষণ এটি। স্বীকৃতির সময় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ছিলেন ইরিনা বোকোভা। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড তার 'We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History' গ্রন্থের ২০১ পৃষ্ঠায় ভাষনটি যুক্ত করেন। ৭ মার্চের ভাষনকে আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে যুদ্ধকালে দেয়া বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তৃতা বলা হয়। ভাষণটি এ পর্যন্ত মোট (২০১৭ পর্যন্ত ) ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।

স্বাধীনতার ঘোষনা : ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীরা নিরীহ মানুষের উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করে। শুধু ঢাকাতেই ৫০ হাজারের বেশী মানুষ হত্যা করে তারা। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬শে মার্চ চট্রগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম এম. এ. হান্নান নিজের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ভূমিকাতে উল্লেখ করেন-

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষনা দেওয়ার পরপরই আমাদের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের পাকিস্তনি সেনাবাহিনী হানা দেয় এবং আমার পিতাকে গ্রফতার করে নিয়ে যায়।

মুজিবনগর সরকার : ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার ভবেরপাড়া গুামের আম্রকাননে মুজবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ দেশ-বিদেশের ১২৭ জন সাংবাদিকের সামনে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার কারণে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন। মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজ উদ্দিন আহমদ। যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে মুজিব নগর সরকার সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি : দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ৩০ লক্ষ্য শহীদ ও দুই লক্ষ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমারা স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রেসকোর্সের ময়দানে আত্মসমর্পন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ। আর এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ছিলেন বঙ্গপন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও সংবিধান রচনা : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকায় এসে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১১ জানুয়ারী ১৯৭২ স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অস্থায়ী সংবিধান’ আদেশ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭২ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং একমাত্র মহিলা সদস্য ছিল রাজিয়া বানু। খসড়া কমিটি ৪৭টি বৈঠকের মাধ্যমে খসড়া চুড়ান্ত করে। ১২ অক্টোবর ১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধান গণ পরিষদে উত্থাপন করা হয় এবং ৪ নভেম্বর ১৯৭২ (১৮ কার্তিক ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ) তা গৃহীত হয়। প্রতি বছর ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর সংবিধানে স্বাক্ষর করা হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে তা কার্য়কর হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে মোট ১টি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগ, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৭টি তফসিল রয়েছে। রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ৪টি। এ পর্যন্ত সংবিধানে মোট ১৬ বার সংশোধনী আনা হয়েছে। ৫ম তফসিলে জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ, ৬ষ্ঠ তফসিলে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ৭ম তফসিলে মুজিবনগন সরকার কর্তৃক জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত হয়েছে।

ফিদেল কাস্ত্রের সাক্ষাত : ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের পর কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন-

আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।

সংবিধান সংশোধন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে এক ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ঘোষনা দেন। Bangladesh Collaborators (Special tribunals) Order, 1972 নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রথম আইন পাস হয়। পরবর্তীতে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আমলে সংবিধান মোট ৪ বার সংশোধন করা হয়। যুদ্ধবন্দীদের বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রথম সংশোধনী আনা হয়। রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি, মেয়াদ ও জরুরী অবস্থার বিধান রেখ ২য় সংশোধনী আনা হয়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তির আলোকে ৩য় সংশোধনী আনা হয় এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিত আত্মজীবনী মূলক প্রথম গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ২০১২ সালের জুন মাসে বইটি ‘দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ থেকে প্রকাশিত হয়। বইটির প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ, প্রচ্ছদ সমর মজুমদার এবং গ্রন্থস্বত্ব ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফকরুল আলম স্যার ‘The Unfinished Memoirs’ নামে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ২০১৭ সালের মে মাস পর্যন্ত বইটি মোট ৮টি ভাষায় প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ হিন্দি ভাষায় অনুদিত হয়। হিন্দি ভাষায় বইটি অনুবাদ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রাণলায়। ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু বইটি লেখেন। বইটি লিখতে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা দেন তার স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালে ফজলুল হক মনির ড্রয়ার খেকে এর মূল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট সাব জেলে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বইটির ভূমিকা লেখেন। বইটিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস সহ বাল্যকাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত নিজের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চট্টগ্রামর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষা বর্ষের পাঠ্যসূচীতে বইটির ইংরেজি অনুবাদ The Unfinished Memoirs অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

কারাগারের রোজনামচা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত আত্মজীবনী মূলক দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’। ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। বইটি ২০১৭ সালের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৯৮ তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে ঐতিহাসিক বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। পাণ্ডুলিপি আনুযায়ী বঙ্গবন্ধু এর নাম দিয়েছিলেন “থালাবাটি কম্বল/জেলখানার সম্বল”। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা বইটির নামকরণ করেন ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটিতে ১৯৬৬-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কারাবাসের চিত্র তুলেধরেছেন। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ শিল্পী তারিক সুজাত। বঙ্গবন্ধু এই গ্রন্থটিতে তাঁর জেল জীবনের পাশাপাশি জেল যন্ত্রনা, কয়েদীদের অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধে লিপ্তহলো তার কথা, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আওয়ামীলীগ নেতাদের দুঃখ দুর্দশা, সংবাদ মাধ্যমের অবস্থা, শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন প্রভৃতি তুলে ধরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড .ফকরুল আলম স্যার বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং তা বাংলা একাডেমী থেকে ‘প্রিজন ডায়েরী’ নামে প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বইটির গ্রন্থস্বত্ব হচ্ছে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’

ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড : ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় সংযোজিত হয়েছিল। দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা সহ এইদিন ঘাতকরা মোট ১৮ জনকে হত্যা করে। তাদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুর শিশু পুত্র শেখ রাসেলও রেহাই পায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল খন্দকার মোশতাক, মেজর ডালিম সহ কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাত। যাদের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা জীবন লড়াই করেছেন তাদেরই কিছু বিপথগামী ক্ষমতালোভীর হাতেই রচিত হয় বাংলার ইতিহাসের কলঙ্কময় দিন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের এই ১৫ই আগস্ট দিনটি জাতি শোকদিবস হিসেবে পালন করে থাকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা করেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানীর পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত বাদী-বিবাদীর আপিলের প্রেক্ষিতে চার দফায় রায় প্রকাশ হয়, সর্বশেষ আপিল বিভাগ ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর থেকে টানা ২৯ কর্মদিবস শুনানি করার পর ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। এতে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

শেষকথা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জীবনী শীর্ষক উপরিউক্ত দীর্ঘ আলোচনার প্রেক্ষিতে আলোচনার শেষপ্রান্তে এসে আমরা বলতে পারি যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে বেইমানি করেছিল তাঁরই সেনাপতি মীল জাফর ক্ষমতার লোভে, নবাব হওয়ার আশায়। ১৯৭৫ সালেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশর প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁরই মন্ত্রীপরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক। ইতিহাস স্বাক্ষ দেয় যে ক্ষমতা লোভীরা স্থায়ী হতে পারেনি মীর জাফর তিন মাসও ক্ষতায় ছিল না। তেমনি ভাবে খন্দকার মোশতাকও তার রাষ্ট্রপতি পদ তিন মাসও রাখতে পারেনি। বাংলার বুকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে এবং বাকীদেরও হবে ইনশাআল্লাহ।

 

রচনা : বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

 

ভূমিকা : বিশ্ব সম্মোহনীদের নামের তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাগ্রে ও স্বগৌরবে অবস্থান করছেন। সম্মোহনীতা বলতে অত্যাকর্ষণজনীত মহিনী শক্তিকে বুঝায়। আর এই মহিনী শক্তি যুগে যুগে কোনো না কোনো ব্যাক্তিত্বে প্রকাশ পায়। আর এসব ব্যাক্তিত্বের আঙ্গুলের ইশারায় পৃথিবীতে মহা বিপ্লব সংঘটিত হয়। ফলে সমগ্র মানব জাতির মুক্তি আসে। তাই বলা যায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের জন্যই সৃষ্টি।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেনপিতা মাতার তৃতীয় সন্তান। সবাই আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। 

শিক্ষা জীবন : ১৯২৭ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ৭ বছর তখন তাকে স্থানীয় গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। তাপর ৯ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করা হয়। পরে তিনি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে ৪ বছর তাঁর পড়ালেখা বন্ধ থাকে। ১৯৪২ সালে তিনি মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ পাশ করেন। এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। পরে তিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। এখানে থাকাকালীন সময়ে চতুর্থ ও কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগদানের কারণে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। ফলে তাঁর ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। 

পাক রাজনৈতিক জীবন : বিশ্ব রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা বাংলা ও বাঙালি জাতির অমর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক জীবন শুরু করার আগে থেকেই গ্রামের মানুষের দুঃখ দেখে নিজের ভিতর এক প্রকার কষ্ট অনুভব করতেন। ক্ষুধার্তদের মুখে নিজের খাবার তুলে দিয়েছেন। শীত আসলেই শীতার্তদের নিজের চাদর দিয়ে সাহায্য করতেন। তখন থেকেই তিনি ন্যায়ের কথা বলতেন। অন্যায় বা অন্যায়কারী যত শক্তিশালী হোকনা কেন তার প্রতিবাদ করতে তিনি বিন্দু মাত্র ভয় পেতেন না। তাঁর একটাই স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতিকে মুক্ত করা। 

রাজনৈতিক জীবনের শুরু ও বিশেষ বিশেষ অবদান : ছাত্র অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সুত্রপাত ঘটে। আর তার রাজনৈতিক জীবনে রয়েছে বিশেষ বিশেষ অবদান। 

ভাষা আন্দোলন : ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ঘোষণা করে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান। সে জন্য তাকে ১১ই মার্চ গ্রেফতার করা হয়। তারপর ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আবারও ঘোষণা করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে আন্দোলনে নামলে পুলিশ গুলি চালায়। ফলে সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিয়ুর সহ আরও অনেকে শহীদ হন। শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বসে সেই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তারপর ২৬ ফেব্রুয়ারি জেলখানা থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। 

৬ দফা দাবি : ১৯৬৬ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি দিয়ে ও অন্যান্য ৩৫ জন সেনা ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করে। পরে ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচারকার্য ঢাকা সেনানিবাসে করা হয়। 

গণঅভ্যুত্থান : ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে `কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এই পরিষদ আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলে। এ পর্যায়ে এ আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানের রূপ নিলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। 

নির্বাচনী বিজয় : ১৯৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। 

মুক্তিযুদ্ধ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তান সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নানা তালবাহানা শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্সময়দানে সর্ববৃহৎ জনসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, 

২০১৭ সালে তাঁর এই ১৮ মিনিটের ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালায়। এমতাবস্থায় ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তাকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় মুক্তি সংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। পরে পাকিস্তান সরকার বন্ধুবন্ধুকে মুক্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। 

জাতি গঠনে অন্যতম অবদান : যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুর সামনে জাতি গঠনের আরেক যুদ্ধ এসে দাঁড়ায়। তিনি ১৬৫০০০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করেন। এছাড়া তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য চাল, ডাল ও রেশনের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পূনর্বাসনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন। ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফ করেন। সমস্ত বিধ্বস্ত কলকারখানা, রাস্তা, ব্রিজ ইত্যাদির পূর্ণনিমান ও মেরামত করেন। শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। কাজী নজরুল ইসলামকে দেশে নিয়ে এসে তাঁর চিকিৎসার জন্য বোর্ড গঠন করেন। পবিত্র ইসলাম ধর্মের সেবায় তিনি ‍যুগান্তকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 

ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড : ১৫ই আগস্টের সেই ভয়াবহ কালরাত। পবিত্র শুক্রবার। রাতের নিস্তব্ধ নিরবতা ভেঙ্গে মসজিদে মসজিদে ফজরের আজান ধ্বনিত হচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সেনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২নং বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। সেই দিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া ঐ বাড়িতে থাকা সকলে শহীদ হন। 

উপসংহার : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে, 

সেনার বাংলা গড়বো পিতা 

পিতা কথা দিলাম তোমায়, 

চেতনা থেকে বিচ্যুত হব না 

গ্রেনেড তবা বোমায়।

রচনা : বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ